চোদ্দ ভূত



ভূত চতুর্দশী চলে গেল। লোকজন চোদ্দ প্রদীপ দিল, যেন এক এক বারে বেশ জনা চোদ্দ ভূত আলো দেখে যেতে পারে। যতই সে "হ্যালোউইনের মতো" বলো-টলো বাপু, এ ভূত গরীব দেশের গরীব ভূত। পাড়াগেঁয়ে ভূতও বলতে পারো আর কি। বেচারাদের এক-একখান গোটা গোটা লণ্ঠন অব্দি নেই গা! দীপের আলোয় ঘর পেরিয়ে যায় বা ঘরে ঢোকে আর কি।

লোকজন বলল, চোদ্দ শাক খাওয়া যায় কিনা, খেলে সে শাকে কচুপাতা পুরে দিয়ে বেশ করে ঠকিয়েছে কিনা। কেউ একবার শুধোলো না, "হ্যাঁ গা, ভূতগুলো কী খেলো"? জামাইষষ্ঠীতে কী জামাই-মেয়েকে উপোস রেখে লোকজন অন্যদিনের ভ্যান্তারা গাইতে বসবে? অথচ ভূতের বেলাতেই যত...



এই এক্ষুনি কেউ বলল বলে, "ওসব ভূতফুত কিচ্ছু নেই। থাকলে দেখাও"। আরে বাপ, কেন নেই, অ্যাঁ? ভগবান থাকতে পারে, মূর্তি না হোক, মনও পাপী -- বাদ দিলাম, ভোগে তো আছেন। সেরকম ভূতেরও ওই চোদ্দশাকে থাকতে বাধা কী? আছে, ঠিক আছে।
তবে দেখানোর কথায় আসি। সে তো চোখের কোণ দিয়ে দেখাই যায়। উপর থেকে নীচে নেমে এলে কে সিঁড়ির কোণায় দাঁড়িয়ে থাকে, নামতে পারে না। ঘরে গেলে কে ওই দূরে থেমে থাকে। তাকালেই আর থাকে না। তাদের না তো আছে ইয়াবড় চোখ, না আছে এত্তোবড় কান। একেবারে খাঁদাবোঁচা পাতি ভূত, জীবনে কখনও কারো খারাপ ভাবেনি, এখন ভূত হয়ে ঘরদোর ছেড়েছুড়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। এইসবের কথা ভেবে লোকজন কোথায় একটু দুঃখ পাবে, তা না, হি হি করে হাসে। ভূতেরা অতো অতো বেশী বেশী হাসে না, যা-ই বলো।
অবশ্য একেবারে যে হাসে না তা নয়। সেই সেবার, রাত্তিরে বাথরুম সেরে বেরিয়ে ঘরে আসতে যাচ্ছি, শুনি পিছনে সরসর করে কিসের আওয়াজ। ভাবলাম, কে জানে, ভামটাম ওঠে খুব গাছ বেয়ে; সেসবই হয়তো। ভেবে পিছনে ঘুরে দেখি কিচ্ছু নেই। কোথাও কিচ্ছু নেই, আমি বাদে সব ফাঁকা। আবার ঘুরে ঘরের দিকে যেতে সেই সরসর আওয়াজ। সে আওয়াজ পিছনে পিছনে একেবারে বিছানার ধার অব্দি এলো। যেন কেউ মজা করে পিছনে এভাবে হেঁটে ভয় দেখাবে ভাবছে। তো, ভয় পেয়ে তার সেই আশা সার্থক করা গিয়েছিল। দিন দুয়েক পর অব্দি সে ছিল।
আরেকজন, সে আরেক মক্কেল - যাচ্ছি উঠতে বিছানায়, হিসহিসিয়ে কানের কাছে ডেকে উঠলো যেন। একেবারে স্পষ্ট। প্রথমে মনে হল, নাঃ, অন্য কিছু। পরের বার যেন একেবারে মুখোমুখি। থাক খোলা ঘর, সে দেখুক যখন এসেই পড়েছে (পরের বাড়ীতে এসে এ কী বেয়াড়াপনা?), আমি চললাম। সে যদিও ওই একদিনের পর আর নয়। হয়তো আলাপ জমাতে চাইছিল। থাক গে, অমন বেয়াড়া আলাপে কাজ নেই - ব্যাদড়া ভূত কোথাকার!
কিন্তু এরা, ধরা যাক, বাজে বা খিল্লিবাজ ভূত। ওরকম উটকো কিছু মানুষও থাকে বটে। তাদের ছাড়াও তো ভালো ভূত অনেক থাকেই এমনিতে। যেমন, দরজার বাইরে বেশ অনেকবার ছায়াটায়া সরে গেলে মানুষজন এসেছে মনে করে যখন দেখি গিয়ে কেউ নেই আসলে, তখন একটু থমকে যেতেই হয়। আশাটাশা ধোঁয়া হয়ে গেলে একা একা প্রথমে একটু খারাপ লাগে, তারপর মনে হয়, নাঃ, না দেখলেও কেউ কেউ তো আছে। থাকুক গে যাক, ভালো থাক বাপ।
তবে এসব বাদে আরও কিছু বিশেষ "স্পুকি" ভূত আছে, আছেই। তাদের দাবী কিছু নয় মনে হয়, কিন্তু তারা শখে যেখানে সেখানে আসে, আবার এমনি এমনি চলে যায়। কিছু খায়দায় না, কিছু করার দায় তাদের নেই। এই খানিকটা ভূতের রাজ্যে ভগবান গোছের ভাব। যেমন মানুষের রাজ্যে বিড়াল। মানে, যারা বিড়াল পোষেন তাঁরা এক্কেবারে ঠিক ঠিক বুঝতে পারবেন আর কি।


সে ব্যাপার হল এই যে, একবার টানা ১১ দিন ধরে (হ্যাঁ, একেবারে কড়ায়গণ্ডায় এ-গা-রো দিন) দেখলাম যে আমার বাড়ির বিভিন্ন অংশে বিড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং আমি তাকে যে দেখেছি বা সেই মুহূর্তে তাকেই দেখছিলাম, সে কথা হলপ করে বলতে পারি। তাকেই অনুপ্রবেশকারী বা কারিনী (বাচ্চা পাড়ার জন্য ঘরে এসে ঠাঁই গাড়লে একটু চাপ হবে বইকি, ঘরে বহু পাখি আসে, তাদের জন্য মোটেই সুখের বিষয় নয়) মনে করে যেই না গেছি তাড়িয়ে দিতে, দেখি নেই। মানে, একটা গোটা বিড়াল, সে আমার দিকে তাকিয়ে, আমি তাকে মিনিট পাঁচেক ঠায় এক জায়গায় দেখে তাড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখি তার জায়গায় অন্য কিছু বা কিচ্ছু নেই সেখানে। এ বড় বিড়ম্বনা ছিল (ভগবানসুলভ সাধে বলা)! দেখা গেল, ফোনে কথা বলতে বলতে গ্যাঁট হয়ে বসে যা দেখছি তা আসলে নেইই। এ কলাগাছের বা শাড়ীর ছায়ায় ভূত দেখা নয়, কারণ একখানা বিড়াল সামনে দেখতে পেলে তার গোটা অস্তিত্ব এমন করে ফাঁপা (যদিও হালকা জীব, তবু জীব তো বটে) ফুৎকারওয়ালা হয়ে থাকার কোন ইতিহাস শুনিনি, এবং আলো জ্বেলে বা অন্ধকারেই সেই জায়গায় একেবারে সামনে এসে ঠাহর করতে করতে দেখা, যা এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল তা একেবারে নেই, বড় সহজ নয়। একসময় মনে হল, দুনিয়ার সব বিড়াল আসলে বায়বীয়! যাক গে, দেবী বাস্তেৎ সে যাত্রা ১২ দিনের দিন একেবারে গোটা হয়ে উপস্থিত হয়ে দীর্ঘক্ষণ দর্শন দিয়ে উদ্ধার করলেন। যদিও ফেরার পথে কোন জানলা দিয়ে গেলেন টের পাওয়া গেল না -- বড়ই কম ফাঁক ছিল গলে যাবার জন্য। সে হোক, দেবী উইথ স্পুকিনেস জিন্দাবাদ (কিন্তু তিনি কী চোদ্দ শাক খান বা খেতেন? কে জানে। সেদিনের সব মাছ তো হয় ফ্রিজে, নয় খেয়ে ফেলেছিলাম!)



তবে ভুতেরাও অবাক হয় বড়। আমি শেষ যাকে দেখলাম, আমার শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সেকেন্ড দুয়েক কি তিন-চার সেকেন্ড আমায় দেখছিল। এই যে দেখছিল, প্রথমে আমি দেখে বাইরের আলো ভেবেছিলাম। তারপর খেয়াল হল, সে আলো আসার রাস্তা বন্ধ, বাইরে আলোও নেই। সঙ্গে, যে জায়গায় দেখেছি, ওইখানে আলো পড়তেই পারে না। না পড়তে পারার ফলে মনে হল আবার দেখি। আর দেখা গেল না। বিড়াল মনে করা যেতে পারত, কিন্তু তাকে বিড়াল হতে গেলে আধবয়সী বাঘ হতে হবে। অত উঁচু তো হয় না। যাই হোক, সে বেচারা শুধু অবাক নয়, দেখলে ঠিক বোঝা যায়, সে চোখে ভয়ও ছিল। সে বেচারা আমায় সেই প্রথম দেখছিল হয়তো, দেখে সে বেচারাই ভয়ে চলে গে'ছিল। যাকগে, এইসব সরল-সহজভূত আশেপাশে দেখলেই পাওয়াটাওয়া যাবে। সবাই এরা বোধহয় আমাদের সাথেই থাকেটাকে। অনেক সময় আমাদেরকে ওদের ভালো লেগে যায় মনে হয়। তখন আর আলাদা করে দেখা যায় না।

মন্তব্যসমূহ