গোভূত
রোমেশ। হ্যাঁ, এক্কেবারে ঠিক নাম পড়েছেন। আসল নাম কী জানা নেই,
কিন্তু রোমশ সে রূপ মানুষরূপী
বনের কথা মনে পড়িয়ে দিত বলে লোকজন ওই নামে ডাকতো।
মানে, এখনও ডাকে আর কি, নেহাত
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই। এই খুঁজে না
পাওয়ার কথাই এইখানে বলবার।
রোমেশ রোমে যায়নি, কিন্তু এ জীবনে রোম
তাকে ছেড়ে যায়নি। খানদুয়েক খাটাল, একখান গবাদিপশুর হাসপাতাল, খানকতক গাড়ি ভাড়ায় খাটে। খুব শীত না পড়লে কখনও
তাকে জামাশোভিত কেউ দেখেনি তেমন করে। সন্ধ্যে হলে খানদুয়েক বাড়িতে নিজে গিয়ে "দু-উ-উ-ধ" বলে আচমকা চেঁচিয়ে বাদুড় উড়িয়ে দিয়ে সে পাড়া ঘুরে
বাড়ি পৌঁছতো। বাড়ি গিয়ে তার খাটাল দেখা শেষ হলে সে দৈনিক কাজ
করত। পরের দিনের বাজারে উঁচু গলায় তার হিসেব শোনা যেত। হ্যাঁ, সেখানেও সে রোমের আকাশে
কাপড়চাপা দিত না। তাকে সেভাবেই দেখা সব্বার অভ্যাস হয়ে গেল।
এতদূর এসে ভাবছেন তো, গোয়ালা মানুষ ছাড়া গোরুর সাথে আর যোগ কোথায়?
গোরু ছাড়ুন, ভূতের কথা আসল বিষয়। রোমের আকাশে কাপড় যেমন ছিল না, তেমন মফঃস্বলে ভূত-পেরেতের গল্প বলা গোয়ালার মত এঁদো বুদ্ধিও
রোমেশের ঘটে ছিল না। রোমপ্রেম বাদে তার অন্যান্য প্রেমের কথা আর কেউ তেমন
জানতো না।
গোরুর ল্যাজ মুচড়ে গোয়ালে ফেরানোর নিয়মকানুন খাটালের আশেপাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটার অভ্যাস যাদের, তাদের সকলেরই চেনা। যদি চেনা নাও থাকে, তবু রোমেশের খাটালের আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করলেই বিষয়খানা স্পষ্ট হবে। আর কেউ না
পারলেও রোমেশ ঠিক এক না একভাবে
গোরু খুঁজে এনে গোয়ালে ভরতো।
ঘটনা ছেঁটে ছোট করা যাক, একদিন এই কাজ করতে
গিয়ে এক গোরু আচমকা
মারে লাফ। সে যে কেন
লাফালো, কি দেখেই বা
লাফালো বোঝা কঠিন। কিন্তু সে লাফে ল্যাজ
হাত ছাড়া হয়ে রোমেশের মুখে পড়ল পিছন পায়ের এক চাঁট। ব্যাপারখানা
শুনতে গুরুতর হলেও দেখতে হল চীনের পাণ্ডা-ভাল্লুকের গাছে উঠতে গিয়ে উলটে পড়বার মত। তার ফলে যারা তাকে তুলতে গেল, তারা অদ্ভুত কেঁপে কেঁপে ওঠা থামাতে পারল না। ফলে শেষ অবধি গোরু হাতছাড়া হল এবং রোমেশ
নিতান্ত খুশি না হলেও তার
ব্যথিত মুখব্যাদান দাড়ির ফাঁকে হাসিসুলভ দাঁত দেখাল। তারও মিনিটখানেক পরে উঠতে পারল সে।
পরে জানা গেল, সে গোরু তার
ছিল না। কার ছিল তা বলা মুশকিল,
কিন্তু চাঁটপরবর্তী ঘটনা হল বেশ অদ্ভুত।
রোমেশের বিষয়ে মানুষজন কিছু কিছু কথা শুনলো। শুনলো গরু-কারবারের কথা, পাচার করা গোরু-বাছুর। কিন্তু না তো হল
থানা-পুলিশ, না হল বিচার-পাতি। রোমেশ রইল রোমেশের মত, কিন্তু অজান্তে কোথাও ভাটা পড়ল।
যা হল, তা এই যে,
রাস্তায় গোরু দেখলেই গায়ে হাত বুলিয়ে বা হ্যাট-হ্যাট
করে, বা ল্যাজ মুচড়ে
নিয়ে যেতে তেমন করে রোমেশকে দেখা যেত না। উলটে দেখা যেত সে এড়িয়ে চলছে।
ব্যাপারখানা এমন হল, তার নিজের খাটালেও সে তেমন যায়
না। পাড়ায় আগের মত সেইসব বাড়িতে
"দু-উ-উ-ধ"
বলে বাদুড় ওড়ানো বন্ধ হতে বাদুড়গোপালেরা সাঁঝবিকেলে তাদের স্বাভাবিক ঝুলনমেলা আবার শুরু করতে পারলো।
রোমেশের ব্যবসাপাতি যা চলার তেমনই
চললো, শুধু বাজারে তার উদার গলা তেমন করে রইল না। খুচখাচ কিছু দোকানদারের আলাপে যা জানা গেল,
সে যেখানেই যায়, হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পায় শিং নেড়ে তেড়ে আসা বা আচমকা চাঁট
ছোঁড়া গোরু। এই হয়ে হয়ে
নাকি তার এমন অবস্থা হয়েছে, নিজেই ঠাহর করতে পারে না তার মাথা
ঠিক আছে না একেবারে গেছে।
খবরপাতি শোনা গেল, সে নাকি এমনও
খোঁজ নিতে গিয়েছিল কোথাও কোনো গোরু সেই যে-কালে সে
চাঁট খেয়েছিল, সেইবেলা মরেছিল কিনা। লোকজন এইসব শুনে কিছু বলেছিল বটে গোরুর রঙ কী, সে
গোরুর চেহারা কেমন এইসব খুঁজে জানলে ঠাহর করে ঠিকটা বলতে পারবে। কিন্তু সেজাতীয় গোরুমন্ত্রকের কোন ঠিকানা না জানায় বোধহয়
তারাও কিছু বলতে পারেনি।
রোমেশের ব্যবসা থামেনি। সে এখনও চলছে।
কিন্তু সেই গোরুর ভূত রোমেশ পথেঘাটে দুমদাম দেখতে পেয়ে গণচমক তৈরি করতে থাকলো। মুখোমুখি সে আসছে হয়তো,
আচমকা বাজখাঁই চেঁচিয়ে "ওরে বাবা রে, দিল রে" বলে একেবারে ছিটকে সরে যেত। যে লোক তার
দিকে চেয়ে হাসতে যাচ্ছিল, সে হয়তো চমকে
উঠে নালায় পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে দেখলো, রাস্তা খালি। একা সে এক পারে,
আর অন্যপারে রোমেশ। এই চলতে চলতে
বেচারা রোমেশ ক্রমে গালি খেতে থাকল। সে গালি যে
ভাবেই শুরু হোক, শেষ হত ওই গোভূত
দিয়ে। শেষে রোমেশ ও গোভূত অভেদ্য
কল্পনা করে লোকজন দুই নামকেই গালি হিসেবে ব্যবহার করত। যে মানুষ গরমে
দরজার কাছে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, সেও রোমেশের নামে খেত গালি, আর গোভূতের ভাগ্যে
রোমেশের মত রোমশ হবার
অভিধা জুটল। এখন, এই অভিধা ক'জন চোখে দেখে
দিয়েছে সে বলা নেহাত
সহজ নয়। রোমেশ বলতে পারতো বলে আমাদের জনকতকের মনে হত, কারণ মানুষজনকে চমকে দিয়ে গালি
খেলে সে বেচারা কিছু আর না বলে বেশ মুখ বুজে চলে যেত। এমন কারণেই একবার ধোঁয়াওঠা চায়ের
ঠেকে ঠিক করা হল বটে বিষয়খানা রোমেশকেই শুধিয়ে নিতে হবে, কিন্তু তারপরেই রোমেশ বেমালুম
উবে গেল। কোথায় গেল না গেল কেউ প্রশ্নটশ্ন করলো না। মাঝের মধ্যে হল এই, নিপাট উটকো
রাগ হলে লোকে রাস্তাঘাটে একে-তাকে “গোভূত” বলে গাল পাড়লেও পাড়াতুতো প্রেমের রাগে সে
নামখানা উহ্য হয়ে গেল।
মন্তব্যসমূহ