হুলোপ্যাঁচা ও অক্টোবরমাস

সবাই জানে এইসময় শিশির পড়ে। তেমনই পড়ছিল। মুখুজ্জে বাড়ির বড় বৌ তখন সাঁঝপিদিম দেখাতে এসেছিল ছাদে। সবে সারা ছাদ ঘুরে পিদিম দেখিয়ে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে, অমনি আওয়াজখানা শুনলো। সে যে কি আওয়াজ তা তো বলে বোঝানো যাবে না, তবে সে মানুষ ডাকছে না প্যাঁচা, নাকি মানুষই প্যাঁচার মতো ডাকছে না প্যাঁচা মানুষের মতো, তা ঠাহর করা যায় না। এদিকে বড়বৌ-এর সাহস খুব। সে তো নিচের তলার দিকে পা না বাড়িয়ে দেখতে চলল কিসে ডাকলো। আবার সারা ছাদ ঘুরল পিদিম হাতে। কিচ্ছু ডাকে না। মনের ভুল কি শোনার ভুল ভেবে বড়বৌ যেই পা বাড়িয়েছে, অমনি আবার! এইবার বড়বৌ কান খাড়া করে শুনল -- না তো, ভুল তো নয়, কিছু একটা সত্যি সত্যি ডেকেছে। কিন্তু কি সেটা? এমন শব্দ আগে কেউ কখনও শুনেছে বলে তো মনে হয় না। বড়বৌ পিদিমখানা নামিয়ে রাখল। এবার তক্কে তক্কে থাকল, ডাকলেই ওইদিকে যাবে। ঠিক তক্ষুনি মাথার উপর কার্নিশে সেই ডাক আবার আর কি একটা হড়াৎ করে গড়িয়ে পড়তে লাগলো যেন। মাটিতেই পড়তো, কিন্তু বড়বৌ চট করে তার আগেই সেটা ধরে ফেলেছিল। তারপর মুঠো খুলে দেখে, এ বাবা, এ কি! কেমন সবুজ সবুজ গা খানা যেন, ঠোঁটএর মতো কি যেন মুখের সামনে কিন্তু ঠিক পাখির ঠোঁটের মতো পুরোটা নয়। গায়ে পালক না আঁশ কি এখানা কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। কেমন হুমদো মুখ করে ডাকতে যাচ্ছে, সবসময় পারছে না, তবে পারলে ওই ওইরকমের একটা আওয়াজ হচ্ছে। বড়বৌ কি করে। ওদিকে পিদিম জ্বলে ফুরিয়ে এল। সে এখন এই এখানা সামলাবে না ওই পিদিম! আর এখানা যে কি তাও তো ছাই বোঝা যাচ্ছে না। মানুষের মতো নয়, পাখির মতোও নয়। তবে? তলায় নামিয়ে নিয়ে গেলে যদি কিছু করে বসে? ওদিকে শিশিরও পড়ছে। জিনিষটা ছোট বলেই মনে হচ্ছে। যদি ফেলে গেলে ঠাণ্ডা লেগে যায়? কিন্তু এগুলোর কি ঠাণ্ডা লাগে?- বড়বৌ খানিক ভাবলো। ভেবে ঠিক করলো যে নিচেই নিয়ে যাবে। যদি খারাপ কিছু হয় তবে জানলা দিয়ে ফেলে দিলেই হল!
নিচে তো গেল নিয়ে, কিন্তু রাখবে কোথায়? চটপট ভেবে নিয়ে বড়বৌ ওখানাকে বালিশের একটা ফাঁকে রেখে গেল কাজ সারতে।
কাজ সেরে টেরে ফিরে এসে দেখতে গিয়ে দেখে, ফাঁক থেকে বেরিয়ে সেখানা গ্যাঁট হয়ে বালিশের উপর বসে আছে। নড়ছে-চড়ছে না। বড়বৌ সামনে এগিয়ে দেখতে গিয়ে হেসে ফেলল। যেন ধ্যান করছে এভাবে বসে। খানিকক্ষণ বড়বৌ হাসলো। তারপর প্যাঁক করে দিল এক ছোট্ট খোঁচা। খোঁচা খেয়ে সেখানা চেয়েই যে শব্দটা করলো সেটা হল এইরকম -"ম্যাউউউম্মম"...।
প্যাঁচা, না বাঘ না বিড়াল কিসের ডাক তা-ই বোঝা গেল না। বেশ খানিক ভেবেটেবে বড়বৌ ভাবল, এটাকে হুলোপ্যাঁচা বললে কেমন হয়? এক তো অদ্ভুত দেখতে। মুখটা না প্যাঁচা, না মানুষ, না বিড়াল, ওদিকে ডানা নেই কিন্তু গোল গোল থাবার মতো হাত রয়েছে, পা ও। তবে? হুলোপ্যাঁচাই সই। ওই ঠিক নাম।
রাত্তিরবেলা বড়দা এলেন। দেখে তো তেনারও হাসি ধরে না। তো তিনি বললেন, "রেখে দাও না, থাক"।
বড়বৌ বলেছিল একটা খাঁচা আনার কথা, কিন্তু দাদা বললেন, "থাক। বেগড়বাই দেখলে জানলা দিয়ে দেবে ফেলে"
কথাটা বড়বৌ এর মনে ধরল। সে হুলোপ্যাঁচা রয়ে গেল।
দিনে দিনে তারপর সেখানা বাড়ল। বেড়ে যেতে অবশ্য পালক কিংবা আঁশ, যাই বল, সেসব খসে গেল। তারপর আঙ্গুল গজালো, নখ হল, দুপায়ে হাঁটাহাটিও করলো বটে, কিন্তু সেই এখনও বেশ সন্ধ্যে নাগাদ হলে ছাদে গিয়ে ওইরকম "ম্যাউউউম্মম" ডাক ছাড়া-টা গেলো না। সেখানা রয়ে গেল। ওদিকে লোকজন এখন তাকে অন্য নামে-ধামে চিনল। মাঝে অবশ্য অনেকরকম অদ্ভুতুড়ে বদমায়েশি যে করেনি তা নয়, কিন্তু বড়বৌ সেই কবেই জানলা দিয়ে ফেলে দেবার গল্প ভুলে গেছে।
*****
ভাবলে এই শেষ? ভুল ভাবলে। বড়বৌএর মাসিশাশুড়ির পিসিশাশুড়ির সেজননদের মাসতুতো জামাইবাবুর ভায়রাভাই-এর পাড়াতুতো পিসি আর খুড়শাশুড়ির খুড়তুতো শাশুড়ি মিলে হুলোপ্যাঁচামো কাটিয়ে ওখানাকে মানুষ করার মন্তর জানতো। তারা একবার সেসব করেওছিল, কিন্তু তারপর যে কাণ্ড...
যাক, আপাততঃ সে হুলোপ্যাঁচা মানুষের মতই আছে। ঝামেলা বড় একটা করে না বটে, শুধু ওই অদ্ভুত ডাক ছাড়া। ওঃ, দেখেছো, বলতেই ভুলে গেছি-- বড়বৌ যেদিন ওখানাকে খুঁজে পেয়েছিল, সেদিনখানা দাগ দিয়ে রেখেছিল ক্যালেন্ডারে লাল কালি দিয়ে। এখনও সে ক্যালেন্ডার আছে। কবে দিনখানা? এই যে, আজকে।
তারিখ এবার যা হোক একখান বসিয়ে নাও দিকি!

মন্তব্যসমূহ